বৃহস্পতিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

সম্পাদকীয়


সম্পাদকীয়

প্রকাশিত হলো 'এবং একুশ' সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সংখ্যা। 

এই সংখ্যার নির্বাচিত কবিরা হলেন -





চয়ন
দীপ রায়
রূপক সান্যাল
ইন্দ্রাণী সরকার
কম্পাস মণ্ডল
সহেলী চক্রবর্তী
শুভাশিস সিংহরায়
পরিতোষ মাহাতো
তন্ময় সাহা
অনুষ্টুপ শেঠ
সুনীতি দেবনাথ
রাবেয়া রাহীম
শুক্লা মালাকার
ঋতব্রত ঘোষ
ঈপ্সিতা মন্ডল
গোপেশ দে
দেবযানী বিশ্বাস
মৌসুমী মন্ডল
পলাশ কুমার পাল
শান্তনু দাম
সোমস্নিগ্ধ মুখোপাধ্যায়







এবং একুশ

চয়ন

ভিখারী
চয়ন




আমাকে একটা বাঁশি দেবে কেউ?
ফুটপাথে ফুটপাথে দৌড়ে দৌড়ে
গায়ে ধুলো মেখে
তোমাদের হাঁটু জড়িয়ে হাত
বাড়াচ্ছি আমি।

দেবে একটা বাঁশি?

সেই বাঁশি যেই আমি ওষ্ঠে ছোঁয়াবো
আমার ফুসফুসের রক্ত
সূর্যের মুখে কালি লেপে দেবে।

আমার লজ্জার রঙে লাল হবে
পূর্বী গোধূলি।

গলা চিরে উঠে আসা ঘেন্নার দলা
পথ ঘাট মাঠ সব
কাদায় ভরাবে।

মেঘের ওপর বসে বাঁশিটা বাজালে
আমার ঘামের গন্ধ ইলশেগুঁড়িতে
নেমে এসে , অসুখ বিকেলে
চামড়ায় শ্বেতী ধরা শহর ভেজাবে।

দাও না গো বাঁশিটা .....

আমার খণ্ড দেহ ভূমিতে ছড়িয়ে
চারহাজার পীঠস্থান সৃষ্টি হয়েছে

এবার আমার চাই ঘন কালো বাঁশি।।





এবং একুশ

দীপ রায়




শিবির
দীপ রায়




শিবির চাইছে নিরন্তর পিঠচাপরানি
বত্রিশ পাটির মোড়কে ক্ষতস্থান লুকিয়ে
তুমি উজাড় করে দিচ্ছ নিজেকে প্রতিনিয়ত

তোমার টানাটানির ঘরে অবিবাহিত কন্যা
তোমার শরিকি বিবাদে দ্রুত রফা দরকার
তোমার বাড়ির বারান্দা বাড়াতে
চাই এন ও সির সাক্ষর
অথবা এরকমই আরও খুঁজে পেয়েছো তুমি
আরও তেরো হাজারটি কারণ

তুমি সমঝে চলছো খুব জল মেপে
তোমার প্রতি পদক্ষেপে লেগে
টুকরো টুকরো আপস
একটি কঞ্চির মাথায়
বাঁধা পাতলা কাপড়
তোমার কব্জিতে ধরা
দাঁড়িপাল্লা, আকাঙ্খা-আশ্বাস

তুমি এগিয়ে চলছো
তুমি এগোবে ভাবছো
নীরবে ঘষে মেজে
উপযুক্ত করে তুলছো নিজেকে

শিবির চাইছে নিরন্তর পিঠচাপরানি
তোমার হাতে প্রায়শই হালকা ব্যথা হয়





এবং একুশ

রূপক সান্যাল



প্রত্যাশার পাশেই

রূপক সান্যাল





প্রত্যাশার পাশেই তুমি ঘুমিয়ে আছ, মেঘ,

কোনদিন কথা রাখলে না –

যতই চেয়েছি নিশ্চিন্ততা, তুমি পুড়িয়েছ

সাংকেতিক ধূপ

আমি কি অত বুঝি ?



পৃথিবীতে জন্মের চেয়ে মৃত্যু হয়েছে বেশি

তাই কি এখনো ছুঁয়ে আছি এইসব শিশুর শরীর?

ভেজা বালুর ওপর কোন্ গুঢ় চিহ্ন এঁকেছিল ওরা?

জড়তার কত রূপ দেখিয়েছ তুমি … …



প্রত্যাশার পাশেই চিরদিন ঘুমিয়ে থেকেছ, মেঘ,

কোনদিন কথা রাখলে না –



এবং একুশ

ইন্দ্রাণী সরকার



চাতকিনী
ইন্দ্রাণী সরকার





জখম তারারা মৃত্যু মৃত্যু খেলা শেষে

শ্মশানে বসে থাকা চাতকিনীর দিকে উড়ে যায়

জ্যোৎস্নায় দুলে ওঠা পাহাড়ের আল

চাতকিনী...

তারা দুই বা চার চোখ মেলে ফরেনসিক কবিতা লেখে

নিজের কাহিনী ধামাচাপা রেখে, অন্যের ঝুড়ি খুলে

সাপের হিসেব করে....

কিছু ব্যকুলতা ঝরে পড়ে, নিজেকে চেনার কালে,

সেখানে বিনাশিকতার নতুন রচনা তৈরি হবে...

চোখ দুটো ক্রমশ: উপরের দিকে উঠতে উঠতে

ফানুসের মত আকাশে উড়ে যায়

জ্যামিতির বই খুলে দেখে হাইপারবোলার ব্যাসার্ধ কি?

পার্টিকল ডায়নামিক্স-এর প্রজেক্টাইল প্রক্ষেপ করে

শ্রী-পূর্ণ আলো আজো অধরা....

খালি ঠোঁট টেপা বা দন্তবিকশিত হাসি অন্যের জানলায়

মুখব্যাদান করে চেয়ে থাকে






























এবং একুশ

কম্পাস মণ্ডল



ঠোঁট
কম্পাস মণ্ডল


তোমার সারাদিনের ক্লান্ত নরম ঠোঁট
এখন আমার ঠোঁটে ডুবে আছে আমৃত্যু পর্যন্ত
চারিদিকে অন্ধকারের স্রোত,
একটা দুটো তারা খসার অবকাশ
আর তোমার আমার ক্লান্ত আঁচড়...
বালিশের তুলোয় লেপ্টে আছে ভোরের আকাশ,
আবার এমন একটা সকাল শুরুর অপেক্ষায়..




এবং একুশ

সহেলী চক্রবর্তী




ছুঁয়ে থাকা নদীর উজান
সহেলী চক্রবর্তী



মাঝরাতে ফের বাইরে দমকা হাওয়া
কুহকিনী মেঘে ঢাকে জোৎস্নার মুখ
জীবন মানে কি এভাবেই ফিরে পাওয়া ,
গত বর্ষায় ফেলে আসা যত সুখ ?

ভেজা চিলেকোঠা , দালান , আলসে , বাড়ি
ভেজা ভেজা মন আর ভেজা পথঘাট -
আলতো আঙুল মায়াবী আবেশে পাড়ি
মল্লারে শিখি মনকেমনের পাঠ।

ভুলে যাওয়া সব দুঃখরা ফিরে আসে
কার লাগি যেন এ হৃদয় থরোথর ,
বিরহশয়নে অস্হির রাত জাগা
বুকের মধ্যে ধু ধু করে ফাঁকা চর।

সঘন গহন রাত বড়ো মায়াময়
একা জানালায় বৃষ্টি মাখছি হাতে ,
তুমিও হয়তো একইভাবে দরজায়
দাঁড়িয়ে রয়েছো আমারই প্রতীক্ষাতে ।

মাঝে কিছু শুধু নামহীন রাস্তারা
বর্ষার রাতে আরো দূরে , মৃদু পায়,
তুমি আর আমি তবু মিশে একাকার
দূরত্বটুকু নদী হয়ে বয়ে যায়।।




এবং একুশ

শুভাশিস সিংহরায়




অস্তিত্ব
শুভাশিস সিংহরায়



আসলে

মানুষের আলাদা কোন অস্তিত্ব নেই ...

সমাধি জুড়ে আবার

ফিরে এসেছে হিমযুগ

কল্পনাতীত শূন্যতার হাত ধরে

দোদুল্যমান

বটের ঝুরিকে সাক্ষী রেখে

জীর্ণ সিঁড়ির সারি

তরতরিয়ে নেমে গেছে হাঁটুজলে

ঠিক যেখানে মিশেছিল আলতা ছাপ ...

পূর্বনির্ধারিত চিত্রকল্পে

নিহিত নুপুর......


আসলে

মানুষের আলাদা কোন অস্তিত্ব নেই

এক মুঠো স্মৃতি ছাড়া









এবং একুশ

পরিতোষ মাহাতো



নির্জন সন্ধ্যা
পরিতোষ মাহাতো



পড়ন্ত বিকেল,মৃদুমন্দ বাতাস
পাড়ে আছড়ে পড়ছে ঢেউ
আনন্দে অন্তহারা ঘরে ফেরা পাখিরা
পশ্চিম আকাশটা সেজেছে নানা রঙে
জেলেরা ফিরে আসছে মাছ ধরে
কয়েকটা রমণী গুঞ্জন করতে করতে মিলিয়ে গেল
গোধুলির সাথে.......
এই রমনীদের মধ্যে ছিলেনা তুমি
তবুও এক পলক দেখার ব্যর্থ প্রচেষ্টা

সন্ধ্যা নামছে,
আধখানা চাঁদের রুপালি আলো এসে পড়েছে জলের উপর
সাদা মেঘেরা ভেসে যাচ্ছে দূর দিগন্তে
চারিদিকে প্রকৃতি তার রূপ
নিজের মতো ছড়িয়েছে
রাস্তার দুধারে গাছের স্রোত
সরু ডালের ভিতর ছোট্ট টুনটুনির সংসার
লোকালয়ের কোলাহলের সমতুল্য
নিস্তব্ধতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তাটা
এই নিস্তব্ধতা দেখনি তুমি
শোননি শূন্য হৃদয়ের আর্তনাদ,,
সবই খুঁজে পাই আমি এই নির্জন সন্ধ্যার আঁধারে।






এবং একুশ

তন্ময় সাহা




ঈশ্বর নির্বাসনে
তন্ময় সাহা




ঈশ্বর তুমি কাকে ভালোবেসে
সর্বত্র আছি বলে, গেলে নির্বাসনে,
এ কেমন প্রেম রেখে গেলে প্রেমময়,
যেখানে চোখের জলে মানুষ তোমায় খোঁজে।


মুখ ফিরিয়েই যদি নেবে তবে
কেন এতো কবিতা লিখল মানুষ,
ফিরে এসো ঈশ্বর, গ্রহন করো
এই চোখের জল, ভালোবাসার পুষ্প।








এবং একুশ

অনুষ্টুপ শেঠ



বিস্ময়
অনুষ্টুপ শেঠ





এক পা ভয়ের ঘরে রাখি,


এক পা আনন্দ-ঝর্ণায়,


এরপর, সূর্য ডোবে যদি


তবু কি এক-ই থাকা যায়!





একভাবে থমকে আছে রাত


তারা-খসা নেইকো আপাতত


একভাবে ধুলোয় মাখা দিন


বয়ে যায়, বিষাদ-আনত,





এক হাত চাওয়ার দ্বারে রাখি,


এক হাত কঠিন নিরুত্তরে,


তাহলে ব্রহ্মকমল দিয়ে


অঞ্জলি ভরবে কেমন করে!





হয়তো বিনাশ এর-ই নাম


হয়তো, এই মৃত্যুঞ্জয়।


একইসাথে ইচ্ছা বিরাগ সুরে


এ খেলার অনন্ত বিস্ময়।






এবং একুশ

সুনীতি দেবনাথ




আমার মন ভালো নেই
সুনীতি দেবনাথ



আজ আমার মনটা ভালো নেই
একটুও ভালো নেই
কেন আমার জানালায় আকাশটা উঁকি
দিলোনা সেই সক্কালবেলা?
কেন সূর্য কুয়াশার চাদর মুড়ে
আমাকে বললো না সুপ্রভাত?

আজ মন ভালো নেই লাবণ্যলতা,
একটুও ভালো নেই।
আজ তোমার হাতের সেই লেবু গন্ধী
এক কাপ কড়া তেতো চা
চেয়েও পেলাম না।
আজ তুমি কোথায় লাবণ্যলতা?

মহাবলীপুরমের সেই দিনটা
সেই যেদিন বুকটা শুকিয়ে কাঠ
হঠাৎ তোমার হাতে এ কী
টাটকা সবুজ কলাপাতায়
মখমলী তালশাঁস তোমার ভালবাসার
মত কোমল নিখাদ !
আমি ইতিহাসের ভাঙ্গা সিঁড়িতে
পাথর থামে হেলান দিয়ে সমুদ্র দেখছি
আর তালপাতার বইটার
পাতা উল্টে পড়ছি ধূসর দিনগুলো,
আর হঠাৎ শুনি ঘণ্টার ধ্বনি
তালে বেতালে পাথর হাতি দলে দলে
আসছে ধেয়ে স্পষ্ট বৃংহণ শব্দে!
আমি দু 'হাতে তোমাকে জড়িয়ে
চিৎকার করে উঠলাম ভয়ঙ্কর!
বিলাপের মত শুনালো।
দেখলাম সারি সারি মত্ত সৈনিক
উদ্ধত তরবারির উচ্চকিত ঝঙ্কার
না না না আমার আর্ত আর্তনাদ
আমি লুটিয়ে পড়েছি বালুকা বেলায়।
হঠাৎ ঠাণ্ডা বাতাস
মায়ের দু ' হাতের মত জড়ালো।
তুমি নেই মা নেই কিছু নেই আমি
এখানে রুদ্ধ ঘরে, আমার ভালো
লাগেনা!

আজ আমার মন ভালো না
লাবণ্যলতা!
আজ সকালে বাস থেকে নেমেছি
ভয়ানক ঠাণ্ডায় থরথর কাঁপছি
আমি কাঁপছি কাঁপছে কাজল
কাঁপছো তুমি বাস ভর্তি ট্যুরিস্ট
আর ধাবার কম্বল মোড়া বুড়োও।
বিশাল.ছাতা তেঁতুল গাছ কাঁপছে
হিমেল বাতাস কাঁপছে ঝরছে পাতা
সেই গরম ধুমেল চায়ের গেলাস
ছোট্ট চুমুক আহা!
খাটিয়াটা মড়াৎ মড়াৎ
ছিটকে গেল চায়ের গেলাস
মীরাটের সেই সকাল আমাকে ধূলিতে
লুটিয়ে দিয়েছে লাবণ্যলতা
বলো মন ভালো লাগে?
মন ভালো নেই, মন ভালো নেই।







এবং একুশ

রাবেয়া রাহীম





সেই অলিক আত্মা
রাবেয়া রাহীম


অবশেষে অপেক্ষার শূন্যতায় ভীষণ নিঃস্ব আমি
ক্ষয়ে যায় প্রাসাদ – কি করে থাকে প্রাণের মেলা!
তোমাকে ছুঁতে না পারার কষ্টে ভীড় করে বহুবছরের ক্ষোভ,
বিফল হতে চায় সহস্রাব্দ প্রণয়--
মৃত্যুর আলিঙ্গনকেও প্রিয়তর মনে হয়।
প্রাপ্তি-প্রত্যাশা, পাওয়া-হারানোর হিসেব
কান্নার করুণ সুর, শুনতে পায় কি কেউ !
বুকের ভেতর অজস্র কবিতা জমে পার হয়ে যায় সময়
নিরব রাতের বুকে সোডিয়াম আলোতে এখনো জেগে থাকি
‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ বারে বার কে যেন বলে যায় !!

ভিজে চুল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল
নরম তোয়ালে জড়ানো আদুরে শরীর!
না স্বপ্ন নয়...সেই অলিক আত্না! বেলা- অবেলায় দেখি যাকে !
স্বমেহন রতিসুখ...
দিন সন মাসের হিসাব থাকেনা,
শুধু মনে পড়ে রোজ, না রোজ নয় প্রতিক্ষণ প্রতিমুহূর্ত
দেখে যাই তার সম্পূর্ণ নগ্ন রুপ,
হ্যাঁ,অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেছি সে মায়াময় রূপ !
কি দুর্লভ ! কি যন্ত্রনা আর শুখানুভূতীর সেই রুপ!
দুচোখ ভরে দেখি তাকে, ভূমিকম্প হয় সমগ্র আমিতে
বলতে ইচ্ছে করে কত কথা, কিন্ত বলতে পারি কই !
তাঁর ভেতরেই যে আমি রই!
শুধু দেখে যাই তাকে, সে আমার সত্য আমার পবিত্রতা..
তাই পাপ বোধ ছিলনা--
দ্রুত বুকের ওঠানামায় লুকানো প্রতীক্ষার অবসান
কোথায় সেই অলিক আত্না! হায় অধরা হয়ে রয়!!


এবং একুশ

শুক্লা মালাকার



যাবার আগে
শুক্লা মালাকার




এখনো অনেক কাজ বাকি

ফুলডুংরির পাথরে লিখে এসেছিলাম যে নির্জনতা

শহরের ধুলায় তাকে খুঁজে পাওয়া বাকি,

ভালকি গ্রামের নিধুকে মাষ্টার করার জন্য ফিরতে পারিনি আজও,

সেই কবে কোন হরিদাস ছুঁড়ে গিয়েছিল এক তেজি দুপুর

ভাঙাচোরা সিঁড়িতে বসে তার হিসেব ফেরত দেওয়া যায়নি,

চাঁদের আলোয় মাখামাখি হয়ে থাকা ঘুমন্ত মেয়ের ছবি

আঁকা হয়ে ওঠে নি,

উন্মাদিনীর কান্না তারা হয়ে ছড়িয়েছে আকাশে

আজও তা গোনা গেল না।



নিজেকে ভুলিয়ে রাখি নানা ছলে, পরম আশ্বাসে

এত কাজ আছে

ভস্মভূমি ডাকবে না কাছে।

শুধু মাঝে মাঝে লেলিহাণ বিষন্নতার তুমুল ঝড়ে ভেঙে পড়ি,

‘আমি নেই’ এই দৃশ্যমান শূণ্যতা রক্তবীজের মতো বেড়ে চলে।



মুঠোফোনের গা ছুঁয়ে ছুঁয়ে পাগলের মতো খুঁজি ‘প্লেটলেট’।






















এবং একুশ

ঋতব্রত ঘোষ



ফরাসি কোনো জাদুছড়ি
ঋতব্রত ঘোষ


মধুর কণ্ঠস্বর শোনার অবকাশ এখন নেই আর ।
একুরিয়মে ঠোঁট ঠুকে ঠুকে ভেসে আছে ওই গোল্ডফিসটা,
কি অস্বস্তিকর যে লাগে ও যখন তাকিয়ে থাকে আমার দিকে,
বা যখন আমি ওর দিকে তাকাই ।
তাকাতেই হয়।
অস্ফুট কথা, ধ্বনি, পায়ে আটকে থাকা ভেজা স্লিপারের ফত্ ফত্
দূরে কোনো বাড়ির ছাদে পাথর পিটছে,
আনমনে শুনি
শুনি এই শব্দগুলো ।
আর ঠোঁট ঠুকে ঠুকে একুরিয়মের দেয়ালের গায়ে
গোল্ডফিস ।
হঠাৎ মনে হল ও চুরমার করে ফেলেছে কাচ,
জলে ভেসে গেছে ঘর,
দেয়াল বেয়ে বেয়ে জলের স্তর বাড়ছে,
কার্নিশ বেয়ে চুঁয়ে পড়ছে,
রাস্তা, শহর জলের ভেসে যাচ্ছে,
কাচের টুকরো বাড়িময়,
জাদুময় লাগছে সবকিছু,
অনর্গল ছটফট করছে গোল্ডফিসটা শুকনো আবেশে,
মাঝের দেয়ালে ভেজা ক্ষত ভরে উঠেছে,
চিড় ধরেছে দেয়ালটায় ।
দুই আঙুলে তুলে ধরি তাজা মাছটাকে,
শেষবার স্তব্ধ হয়ে যাবার আগে
পরখ করি ওর ঠোঁটদুটো,
ড্যাবড্যাবে চোখের না থাকা পাতা
নজর করি,
আঁশ
আঁশের গড়ন,
জরির কাজ,
আমার চোখ কপালে ওঠে
তখনই যেন দৃশ্য বদলে যেতে অবাক হই,
ছলকিয়ে ওঠা জলের তরঙ্গে ভাসতে ভাসতে
চলে যাই তোমার বাড়ি
সচকিত তোমার আঙ্গন
ভরা যৌবন তোমার,
এক নিঃশ্বাসে
ধোঁয়ার বিস্তারে
পলকের এক লহমায়
নিঃশেষ করি তোমাকে ।
মনে আছে
তোমার ঠোঁট দুটি
আর কাচের স্তন
নিজের ঠোঁটের আয়ত্তে নিতে নিতে নিতে
চুরমার হয়ে গেলাম,
খণ্ড খণ্ড হয়ে অণু,
গুণকের অবশ্যম্ভাবী অনুমানে নিজেকে জেগে উঠতে দেখে
শেষবারের মতো স্তব্ধ হয়ে যাই
নিবিড় শুকনো সান্নিধ্যে ।








এবং একুশ

ঈপ্সিতা মন্ডল




সাদা-কালো
ঈপ্সিতা মন্ডল



জানালা দিয়ে চাইলেই দেখা যায় --
বিস্তীর্ণ প্রান্তর, সাদা বরফে ঢাকা;
তারই কোণে ক'টি পর্ণমোচী বৃক্ষ,
বরফের পরতে মোড়া তাদের কৃষ্ণবর্ণ শাখা ।

মধ্যেমধ্যে সে প্রলেপ ঝরে পড়ে,
উস্কানি দেয় তীব্র হিমেল হাওয়া;
খামখেয়ালী ভাঙন যেন ছোট্ট সাদা প্রাচীরে;
ভ্রুক্ষেপহীন কাঠবিড়ালীর ক্ষিপ্র আসা-যাওয়া।

মাঠের অন্য প্রান্তে চোখে পড়ে,
সগর্বে মাথা উঁচিয়ে গগনচুম্বী আবাসন;
বেড়ার গায়ে মোটরগাড়ির সারি,
তাদের দেহেও সাদা বরফের পুরু আস্তরণ।

এরই মাঝে আবার শুরু হয়
দমকা হাওয়া,নতুন তুষারপাত;
তুলোর পরতে আবার ভরতে থাকে
সযত্নে সাফ করা আবাসন-ফুটপাথ। ।






এবং একুশ

গোপেশ দে









আমার বয়স্ক সন্ধেটুকু
গোপেশ দে



আমার বয়স্ক সন্ধেটুকু হাপিত্যেশ দিয়ে থাকে গ্রীলঘেরা ব্যলকনি মাঝে।
চোখেতে ধুয়াশা ঘেরা মোটা লেন্সের চশমায় আমাকেই শুধু দেখা যায়।
আমাকেই আমি শুধু দেখি কথা বলি অচেনা আমার সাথে শুধু
অচেনা আমি কিন্তু চেনা আত্নার সাথে মিশ্রিত হয়ে কথা বলি নিরন্তর সঙ্গোপন করে দীর্ঘশ্বাস।
এখানে দাঁড়িয়ে থাক,
না চল ভেতরে যাই চায়ের আশায়,
না থাক বলছি,
ঠিক আছে আর একটু থাকি-
কথা কাটাকাটি শেষ।
মুখেতে রোমন্থনে জানালার গ্রীলে ঠেস মেরে
চোখ দিয়ে দেই দূরের ল্যাম্পপোস্ট পার করে হরিপদর চায়ের দোকানে।
একাকী বিহঙ্গ হয়ে সঙ্গীহীন বুড়োভামে আবিষ্কার করি কোনো স্মৃতি।
স্মৃতির আদতে সেই শৈশব স্মৃতির নিউরন পৃষ্ঠা খুলে যায়।
দৌড়াদৌড়ি,
লাফালাফি,
উড়াউড়ি,
দস্যিপনা,
ইত্যাদি ইত্যাদি....
তারপর....
নিজের স্বেচ্ছাচারী অব্যর্থ রাগের মশলায় মিশে যাই।
আজ এই টিনটিনে শরীরে হাড়গোড় সব গোনা যায়
যেন হৃদপিন্ড বাজাচ্ছে ধ্বনি, প্রতিধ্বনি বেশ চুপচাপ।
আর রাস্তায় দুরন্ত শিশু আমাকে দেখে মুখ ভেংচি কাটে।
আমি হেসে কূল পাইনা একাকী জানালার পাশে একাকী হয়ে।
এইত চলছে বেশ সময়ের সাথে ধরনা দিয়ে।
এইত চলছে বেশ সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে।








এবং একুশ

দেবযানী বিশ্বাস






ভিজছে শহর তোমার আমার
দেবযানী বিশ্বাস






ভিজছি আমি,ভিজছ তুমি,ভিজছে শহর কোলকাতা-

উড়িয়ে দিল দমকা হাওয়া খোলা ছিল যেই ছাতা।



সকাল থেকে সন্ধ্যে গড়ায়,বৃষ্টি যেন অন্তহীন-

জল নামছে চোখের পাতায়,মুক্তোগুলো বেশ রঙীন।



শহর জুড়ে জলছবিতে ধূলি ধূসর সব উধাও,

আলিঙ্গনে মুগ্ধ দু চোখ,ব্যস্ত নগর,থমকে যাও।



সারি সারি দাঁড়িয়ে গাড়ি,গাছ পড়েছে মাঝপথে-

একটা কোণে লক্ষ্মী মেয়ে ভেজা জুঁইয়ের মালা গাঁথে।



পথের বুকে তড়িঘড়ি,হাজার হাজার ব্যস্ত পা;

ফিরতে হবে উষ্ণ নীড়ে,সময় তাদের খুব মাপা।



বাসের জানালায় মুখের সারি,কুঁচকে ভুরু গালেতে হাত

অনাসৃষ্টির ঝঞ্জাটেতে পথের মাঝেই বাড়ছে রাত।



আপন ছন্দে আসছে হেঁটে বইয়ের ভারে পাঁচটা পিঠ-

খলবলিয়ে শব্দ ঝরে,ওয়েদারটা দারুণ হিট।



মলগুলি সব উদাস চোখে,কেউ কেনে না আজ ফ্রি তে,

শুধু তেলেভাজার গন্ধ ছড়ায় পাশের ছোট গুমটিতে।



টিনের চালে শব্দ ওঠে,আদা চায়ে কয়জনা-

আকাশ চিরে নিয়ন ঝিলিক,দিঘির বুকে আলপনা।।







এবং একুশ

মৌসুমী মন্ডল






মহাশ্বেতা
মৌসুমী মন্ডল


সবাই মাতৃজঠরের অন্ধকার থেকে ফিরোজা আলোয় আসে।
আবার ফিরেও যায় নিশাচর হয়ে।
শুধু মাঝেমধ্যে কারো কারোর মধ্যে
আলো থেকে যায় জলপ্রপাতের মতো।
এমনটা কল্লোলিনী মহাশ্বেতার
ক্ষেত্রেও ঘটেছে।
তিনি চলে গেছেন।
গত দু 'দিন ধরে আমরা
শোকগুলো বিছিয়ে রাখছি
নন্দনের ঘাসে, দেয়ালে, কাঠের ফ্রেমে,
ইঁটে, বইয়ের পাতায় আর কিছু অশৌচ ফুলের পাপড়িতে।
পাশেই কাঁচের গাড়িতে শায়িত
'হাজার চুরাশির মা '।
শরীরের পাকেপাকে তাঁর জ্বলছে চাঁদ।

শবরেরা শোকগুলো বিছিয়ে রাখলো কলজের রক্তকিংশুকে আর জারুল
বনে বনে।
শাল পিয়ালেরাও মালভূমির আঁধারে দাঁড়িয়ে কেঁদে কেঁদে লাল কাঁকুড়ে
মাটি ভেজালো।
পাতার ফোঁকর দিয়ে দেখলো একটা অন্ধকার মিছিলে শববাহী গাড়িতে শুয়ে আছে এক আলোর শরীর।

মহাশ্বেতা মেয়েটি ভীষণ ঠান্ডা ছিলো। তার পায়ের ছাপে
ছাপে সোনালি ধানের সুঘ্রাণ।
কথা বেয়ে বেয়ে নেমে আসতো নারী জাগরণ, আদিবাসী আন্দোলন আর সাহিত্যের রেনেসাঁ।
চলে গেলেন মহাশ্বেতা।
তাঁর আলোকে নেভাতে পারে
এমন ঝড়ো বাতাস আর নেই।






















এবং একুশ

পলাশ কুমার পাল






কথাতেই
পলাশ কুমার পাল




কথাতেই ভাসি      কথাতেই জাগি
          কথাতেই রাখি মাথা-
ভাবনাগুলো          কার পাশে শুলো
           বিনিদ্র রূপকথা...
শ্রাবণ ঝরে ঐ          উল্টে যাই বই
           নদীপারে একা ডিঙি;
দীর্ঘশ্বাস শুধু            মাঝিহীন ধুধু
            ঢেউকাব্য উদাসিনী।
কথাতেই তুমি           কথাতেই আমি
              কথাতেই ভেজে ভূমি;
চাঁদহীন আজ           তারাহীন রাত
              কথাকেই যায় চুমি।
ডাকনামে সেথা         মিঠেছোঁয়া একা
               বেজে যায় রাতবাঁশি;
সুরে সুরে গাঁথা          মরমের ব্যথা
                কথাতে সে মুক্তোহাসি!














এবং একুশ

শান্তনু দাম




সায়ংকালীন সন্ধিক্ষণে
শান্তনু দাম




সন্ধ্যা নেমে আসে

পাখিরা ঘরে ফেরে

দিনের অবশেষে

ক্লান্তি ছেঁকে ধরে।

ছেলেরা মাঠে বসে

খেলার পাট সেরে।

কোথাও কিশোরীরা

হাসিতে ফেটে পরে

প্রেমিক প্রেমিকারা

নিরালা খুঁজে ফেরে।

নতুন গৃহবধূ

স্বামীর পথ চেয়ে

একেলা ভাবে শুধু

কি কবে কাছে পেয়ে।

পড়ুয়া শুরু করে

সরব পূঁথিপাঠ

নিরালা হতে থাকে

নিঝুম পথঘাট।

এ হেন সন্ধ্যায়

শিল্পী খুঁজে পায়

তাঁরি সুরের রেশ

নিজের সাধনায়।।






এবং একুশ

সোমস্নিগ্ধ মুখোপাধ্যায়




জাতিস্মর
সোমস্নিগ্ধ মুখোপাধ্যায়







চূড়ান্ত ধ্বংসের পরে -

যদি শুধু বেঁচে থাকি তুমি আর আমি আর আমাদের মেয়ে,

তবে সেই গাঢ় অন্ধকারে,

নক্ষত্রের শাশ্বত আলোয় নতজানু হয়ে,

আমি শুধু চেয়ে নেব, হে ঈশ্বর - বাগানের শুধু এক ফুল,

যে ফুলের নাভীমূলে যত্নে রাখা পরাগকেশর -

আবার নতুন করে সভ্যতার জন্ম হবে বলে,

স্বভূমি যে চিনে নেবে অবিকল নিখুঁত, নির্ভুল।







এবং একুশ