অষ্টম সংখ্যা ব্লগে আপলোড করা শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ। রাতও হয়েছে অনেক। ঘুম আসছে না। বাইরে অবিশ্রান্ত ধারায় বৃষ্টি পড়েই চলেছে। সেই ভোর থেকে যে শুরু হয়েছে, এই মাঝরাত পর্যন্ত থামার নাম নেই। মনের ভেতরটা কি এক অজানা কারণে অসম্ভব অস্থির। আজ সত্যিই ‘অশত্থপল্লবে বৃষ্টি ঝরিয়া মর্মরশব্দে নিশীথের অনিদ্রা দেয় যে ভরিয়া...’
সঙ্গপরশহারা অন্ধ বিভাবরীর দুর্নিবার টানে পায়ে পায়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। রাস্তার হলদেটে আলো বাগানের গাছগুলোর ওপর পড়ে এক অদ্ভুত আলোআঁধারির জাফরি কাটা নকশা তোলা মায়ালোকের সৃষ্টি করেছে। বাগানের একদিকে সার দিয়ে তিনখানা বড় বড় আমগাছ। পাঁচিলের ধার বরাবর সুপারি গাছের প্রহরা। বৃষ্টির অবিরল ধারা যেন ধোঁয়ার মতো এক ধূসর অস্বচ্ছ আস্তরণের আচ্ছাদনে সমস্ত ঢেকে দিয়েছে। সব ছাড়িয়ে চোখ চলে গেল দক্ষিণপশ্চিম কোণ বরাবর আমার প্রিয় সুবিশাল গাছটির দিকে। কদম গাছ। প্রায় বছর পনের আগে আমারই হাতে লাগানো। আজ ডালপালা মেলে বাগানের অনেকখানি আর আমার মনের প্রায় সবটুকু জুড়ে বিরাজমান। ফুলে ফুলে সাদা হয়ে গেছে। নেশায় আবিল করা গন্ধে চারিদিক ম’ম’ করছে। বর্ষার এই কটা দিনের জন্য আমি সারা বছর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকি। তাকিয়ে থাকতে থাকতে মায়ালোক হতে আমার মনের ছায়াতরণী পাড়ি দিল স্বপ্নপারাবারে...
আরো কত কিছুর সঙ্গেই তো সম্পৃক্ত ছিলে তুমি। সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে তোমার এখনও? আমি ভালবাসি বলে তিনতলার শ্যাওলাধরা কার্নিশে নেমে কতবার কদমফুল তুলে দিয়েছ... তখন কি পরিতৃপ্ত, পরিপূর্ণ লাগত। এখন ভাবলেও বুকের ভেতরটা ভয়ে হিম হয়ে যায় – যদি পা পিছলে... উফফ, কি অসম্ভব ছেলেমানুষি!! কতই বা বয়স ছিল তখন? পনের কি ষোল হবে। অনুভূতিগুলো অনাস্বাদিতপূর্ব। কথায় কথায় অভিমান করতাম তোমার ওপর। এমনই এক দিনে কি যেন লিখেছিলে তুমি...
আজ আকাশ জুড়ে মেঘের ক্যানভাসে
তোমার আমার না-বলা যত কথা
সারা দিন ভার হয়েছিল ধুসর রঙের
আভিমানের মত। বিকেলের দিকটায়
আর বইতে পারল না ভার। ঝরে
পড়ল অঝোর ধারায়...
বুকের ভেতর টনটনে ব্যথা যেমন
ঝরে পড়ে একদিন
অবিরত কান্না হয়ে
এ কেমন ভালবাসা তোমার
গভীর বেদনা যত গভীরে বাজে বুকে
তত আরো নিবিড় করে পাওয়া
রঙ লাগে ক্যানভাসে মনে
তারপর সব রঙ মিশে মিশে
রামধনু রামধনু তোমার ভালবাসা
লাল নীল হলুদ সবুজ রঙ মিলান্তি
নদী হ’য়ে যায়
মিশে যায় তোমার অতলান্ত গৌরবে
সেখানে বিরামহীন ধারায়
দিগন্ত রেখায়
যুগলের দৃশ্যপট আঁকে
আত্ম উৎসারণের উষ্ণ প্রস্রবণ
একাত্মতার শেষতম স্বর্গে
উপলব্ধির অন্তিম প্রাপ্তিতে
আর পূর্ণতার সবুজ অন্ধকারে
তখন সেই প্রশান্ত নিমগ্নতায়
সব অশ্রু মিশে যায়
সারণির গভীর নীল স্রোতে
শেষ হয় পূর্ণ পরিক্রমণ
সেদিন অনাবিল আবেশে বলেছিলাম, এই কথাটি কবি, পড়বে তোমার মনে বর্ষামুখর রাতে... কিন্তু পরিক্রমণ তো শেষ হল না!!
আমার দুটো গোল্ডফিশ ছিল, তোমার মনে আছে? বিন্দি আর বুলেট। একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি বুলেট ভাসছে জলের ওপর। আমার সে কি কান্না! ভাই কত খুঁজল, কিন্তু ওই সাইজের গোল্ডফিশ কোত্থাও পাওয়া গেল না। সারা কলকাতা খুঁজে শেষমেশ তুমি জোগাড় করে দিলে সল্টলেক হবিসেন্টার থেকে... এবারেরটার নাম দিয়েছিলে ‘ফ্যাঁচফ্যাঁচ’।
সেদিনও সারাদিন অজস্র অবিরাম ধারায় বৃষ্টি পড়ে সমস্ত শহরটা সাদা হয়ে গিয়েছিল। কাঁচের অর্কিড হাউসের ভেতর সেদিন তুমি আমায় প্রথম... কেন চলে গেলে আত্রেয়? এতো বুঝতে তুমি আমায়, আমার সেদিনের সেই অভিমানটুকু বুঝলে না? ভালো করে জানতেও তো তুমি চাওনি কিছু সেদিন!! চলেই যদি গিয়েছিলে, তবে এতোদিন পরে আবার ফিরে আসছো কেন? কি বলতে চাও? জানতে চাও কি কিছু? শেষ করতে চাও কি পরিক্রমণ?
রাত বোধহয় শেষ হয়ে এল। পুবের আকাশে আলোর আভাস। বৃষ্টির বেগও কমে এসেছে অনেকখানি। আমার তো হাজারও সমস্যা, আমি খুঁজে ফিরি আমার প্রশ্নের উত্তর। আপনারা বরং ততোক্ষণ ডুব দিন ‘এবং একুশ’-এ।
ভ'রে থাকুন ভালবাসায়....
সুস্মিতা বসু সিং
এবং একুশ