ষষ্ঠ সংখ্যার কাজ একটুও হয়নি। আজ একটা ছুটি পাওয়া গেছে। ঠিক করেছিলাম বেশীরভাগটাই সেরে রাখবো। কিন্তু দুপুর থেকেই আকাশটা মেঘলা। জানলার গরাদ পেরিয়ে আমগাছটার পাতাগুলোর ফাঁক দিয়ে মনটা বার বার ওলটপালট... এলোমেলো ছেঁড়া ছেঁড়া কতকগুলো মেঘ কেমন যেন দিশাহারা, কি যে করবে! যাবে, না থাকবে? এদিক যাবে, না সেদিক? কিছুই কেমন ঠিক করতে পারছে না। দেখতে দেখতে বেলা বয়ে গেল...
বিকেলের দিকটায় আচমকা এক ঝলক উত্তাল হাওয়া আর একটা
ঘন কালো মেঘ চারদিক আঁধার করে ধেয়ে এলো। তারপর মেঘটা নিজেরই ভার আর বইতে না পেরে
বড় বড় ফোঁটায় ঝরে পড়তে থাকল অবিশ্রান্ত ধারায়। আর বসে থাকতে পারলাম না। বারান্দার
দরজাটা খুলতেই মাটি ভেজা সোঁদা গন্ধ মেশা বৃষ্টির একটা প্রবল ঝাপটা আছড়ে পড়ে
ভিজিয়ে দিল শরীর মনের অনেকখানি। ধড়াস করে উঠল বুকের ভেতরটা। এক ঝটকায় মনে পড়ে গেল
বারো-তের বছর আগের সেই দিনটা।
কিংশুককে প্রথম দেখি বিমল বাবুর ক্লাসে।
স্বভাবসিদ্ধ কমনীয় ভঙ্গীতে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বোঝানোর চেষ্টা করছেন বিমলবাবু,
ছেলেমেয়েরা যে যার মত ব্যস্ত। হঠাৎ পিছন থেকে কেউ একজন গম্ভীর গমগমে গলায় বলে উঠল,
কৃষ্ণ মোটেই ওই রকম ন্যাকা ন্যাকা লোক ছিলেন না!!! মুহূর্তে সারা ক্লাস নিস্তব্ধ, বিমলবাবু উঠে
বেরিয়ে গেলেন। দুবছরে আর কখনো আমাদের ক্লাস নেননি তিনি।
যেচেই আলাপ করলাম। শিলিগুড়িতে বাড়ী। নানা বিষয়ে
অগাধ জ্ঞান। ওর কাছেই জানলাম, ওর দাদু ছিলেন সংস্কৃত পণ্ডিত। বাড়ীতে প্রায় পাঁচ
হাজার বইয়ের লাইব্রেরী আছে। অচিরেই জমে উঠল বন্ধুত্ব। ক্লাসের পর রোজই চলে আলোচনা। কোন দিন পূর্ণেন্দু, তো কোন দিন
নৃসিংহ। কখনো শক্তি-সুনীল, কখনো বা সমরেশ-বুদ্ধদেব। যেদিন রবীন্দ্রনাথে ডুব দেয়,
সেদিন আর ওকে খুঁজেই পাওয়া যায় না। আবার কোন কোন দিন বিংশ-একবিংশ শতাব্দীর ইংরাজী
সাহিত্যে সাঁতরে বেড়ায় আপন মনে।
ওর কথা শুনতে ভাল লাগে আমার। চুপ করে শুনি, ও বলতে
থাকে...কেমন একটা ঘোরের মধ্যে যেন। ক্লাসের পর রোজ বিকেলে। কোন দিন কলেজ স্কোয়ারে
ওয়াই এম সি এ-র ক্যান্টিনের সামনের বেদীতে, কোন দিন বা হাঁটতে হাঁটতে সে...ই
হেদুয়ার বেঞ্চে। কখনো একান্তই সেন্টিনারী বিল্ডিং-এর সিঁড়িতে। তবে বেশিরভাগ দিনই
দ্বারভাঙ্গার ওপর তলার গ্যালারীতে। ঘন্টার পর ঘণ্টা বসে বসে তন্ময় হয়ে শুনি ওর
কথা, যতক্ষণ না শশাঙ্কদা এসে তাড়া লাগায় দরজা বন্ধ করার জন্য।
সেদিনও অমন গ্যালারীর বেঞ্চে পা গুটিয়ে বসে ডুব
দিয়েছি মুগ্ধতায়। আজ ও পড়েছে মহাভারত নিয়ে, শান্তনু-দেবব্রত-সত্যবতী... তলিয়েই
গেছে বুঝি নীল যমুনার কালো জলে। হঠাৎ চুপ করে গেলো... চারিদিক নিস্তব্ধ। তারপর
অকস্মাৎ স্বপ্নোত্থিতের মতো ঘোর লাগা গলায় বলে উঠল, জানো তো, আমি এই যোজনগন্ধাকে
চিনি। আবার চুপচাপ চারদিক। কোনও শব্দ নেই... এক মিনিট, দু মিনিট, পাঁচ মিনিট...ঠিক
জানি না কতোক্ষণ। শশাঙ্কদা এসে তাড়া লাগালো, সেকি, যাও নি এখনো? পালাও
পালাও...বৃষ্টি আসছে খুব জোর।
দৌড়োতে দৌড়োতে বেরিয়ে এলাম। আকাশটা এক্কেবারে মিশমিশে কালো।
ক্যাম্পাস প্রায় খালি। রাস্তায় এসে দেখি উল্টো দিক থেকে ঘটাং ঘটাং করে আসছে
একটা পাঁচ নম্বর ট্রাম। এক ছুটে উঠে পড়লাম ট্রামটায়, এসপ্ল্যানেড থেকে মেট্রো নিয়ে
নেব। ট্রামটা সবে ওয়েলিংটন দিয়ে ঘুরেছে, শুরু হল দুর্দান্ত বৃষ্টি। চারিদিক ভেজা
মাটির সোঁদা গন্ধে ম’ম’ করতে লাগল। চোখ বন্ধ করে এক বুক গন্ধ নিয়ে চোখ খুলতেই
দেখি, স্নিগ্ধ স্মিত চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
এসপ্ল্যানেডে নেমে অনাদি কেবিনের শেড পর্যন্ত আসতে
আসতে প্রায় ভিজেই গেলাম। সরু শেডের নিচে তখন অনেক ভীড়। ঘেঁষাঘেঁষি ঠেলাঠেলি করে
বৃষ্টি থেকে বাঁচার চেষ্টা প্রায় বৃথা। ততক্ষণে আরো ভিজে একশা, শীত শীত করছে।
ঠেলেঠুলে আরো একটু ভেতরে যাওয়া যায় কিনা ভাবছি, হঠাৎ পাশ থেকে বৃষ্টি আড়াল করে
আমার সামনে এসে দাঁড়াল কিংশুক। আমার নাকে তখন বৃষ্টি ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ ছাপিয়ে
ডেনিম ডিও-র ভেজা ভেজা গন্ধ। আর কানের কাছে গুনগুন গুনগুন... বিবাহিত রমণীর কত যে
ঝঞ্ঝাট থাকে... বিবাহিত রমণীর কত যে ...
এর পর কেটে গেছে আরো দুটো বছর। হঠাৎ একদিন একটা
চিঠি এল আমার নামে। আশ্চর্য হলাম রীতিমতো। আজকাল আবার চিঠি কে লেখে? কোথা থেকে
এসেছে বুঝলাম না। প্রেরকের নাম নেই কোথাও, পোস্টাল স্ট্যাম্পটাও কালি ধেবড়ে পড়ার
অযোগ্য। নীল রঙের মুখবন্ধ খাম, খুলেই চমকে উঠলাম – নীল রঙেরই কাগজে অসাধারণ হাতের
লেখা –
কৃষ্ণচূড়া গাছটার ডালে
একটা নাম না জানা পাখী
কালো নীল উজ্জ্বল খয়েরী
আজকাল প্রায়ই আসে দুপুরে
ঠিক যখন আর লেখায়
মন বসেনা
কিসের যেন একটা প্রত্যাশায়
অন্যমনস্কতা
কার কথা যেন
বার বার মনে পড়ে
ঝিরঝিরে পাতাগুলোর ফাঁক দিয়ে
মন আকাশচারী...
ও এলে কেমন যেন
প্রথম বৃষ্টিতে ভেজা মাটির
সোঁদা সোঁদা গন্ধ পাই
আজ একটা নাম রেখেছি ওর -
যোজনগন্ধা
শরীরটা কেমন অবশ হয়ে গেল। কোথাও কোনো সম্বোধন নেই,
নাম নেই...কে লিখেছে এ চিঠি? কিংশুক? আমার বাড়ীর ঠিকানা পেলো কোথায়? কেন লিখল এমন
চিঠি? বাড়ীর লোক যদি জানতে চায়, কার চিঠি? কি লিখেছে? কোথায় থাকে এখন? শিলিগুড়িতেই
থাকে এখনও? দুপুর বেলা বসে বসে কি লেখে? রোজ লেখে? কি করে এখন ও? সব তালগোল পাকিয়ে
যাচ্ছে... কানের কাছে আবার সেই গুনগুন গুনগুন... বিবাহিত রমণীর কত যে ঝঞ্ঝাট থাকে...
বিবাহিত রমণীর কত যে ...
অনেক দিন পর আবার মনে পড়ে গেল সব কথা। আজ আর কোনো
কাজ হবে না। আপনারা কবিতা পড়ুন, আর আমায় আজ একটু ছুটি দিন, প্লিজ...
সুস্মিতা বসু সিং
এবং একুশ
তিনকুলে তো কেউ ছিলোনা, এক্কেবারে একলা এখন।
উত্তরমুছুনকে তাহলে ভাত বেড়ে দেয় ? কে ডেকে দেয় সকাল সকাল ?
রাত্তিরে কে দরজা খোলে ? ঝক্কি পোহায় হাজার রকম ?
কার বিছানায় ঘুমায় তবে ? কার গায়ে হাত তোলে এখন ?
কার গায়ে হাত তোলে এখন?
~ জয় গোস্বামী