ভাষার আ
ভাষার আমি, ভাষার তুমি
শর্মিষ্ঠা
ঘোষ
আমাদের মহা কনফিউসিং কালের গালগল্প সেসব । সে বেদম অস্তিত্ব সঙ্কট.
আমাদের
ভাষার ঠিক ঠিকানা নেই । মূল ফুল উপড়ে আনা এপারে চলে না ওপারের
ভাষা
...অথচ আমাদের রক্তে এখনও ওপারের এসেন্স । ভাষার ওপর যতই দামী চাদর
চড়াও,
ঝুটো গয়না গাটি পরিয়ে বিয়ের কনেটি সাজাও,
তবু বাপের দৈন্যদশা ঠিক
ধরে
ফ্যালে নাক উঁচু অভ্যাগত । পৈত্রিক সূত্রে বরিশালী,
মাতৃতন্ত্রে
দিনাজপুরি,
সেই সাতচল্লিশে ছিন্নমূল হয়ে আসা,
তারপর কচুরিপানার মত ভেসে
ভেসে
ভাড়া বাড়ির ছোট্ট চৌহদ্দি, অনেক
পরে বনজঙ্গল সাফ হয়ে নিজের বলতে এক
ফালি
জমি , তখনো এ জায়গা আক্ষরিক অর্থেই
গঞ্জ, রাতে শেয়াল ডাকে,
দিনে
হুল্লোড়
করে বেড়ায় অগুন্তি বাঁদর, প্রত্যেক
বাড়িতে বড় বড় আম জাম কাঁঠাল
বেল
গাছের ছড়াছড়ি, পাতকুয়োয়
পানীয় জল, ঘুঁটে খড়ির উনুনে রান্না হয়,
মেটে
হাঁড়িতে ভাত নামে, মাঝে
মাঝেই হাঁড়ি ফেটে উনুন ভুস । ইজের পরা আর
পায়ে
চটি না জোটা আমার বাবার ছোটবেলা, পাজামা
আর শার্ট পরা কলেজ বেলা,
নেহাত
স্টাইপেন্ড জুটে যেত বলে পড়াশুনো চালাতে পারা স্কুল বেলা,
সময় ছিল
না
সফিসস্টিকেড ভাষার খোঁজ রাখার , আমার
আর ভাইএর ছোটবেলা তাই আম্মার
মানে
আমার ঠাকুমার খামু, যামু,
কমু র আর কাকিমা জেঠিমা দের খাইছে,
করছে,
বলছে র চক্করে ক্যাডাভারাস ... আমার তখন ক্লাস ফাইভ সিক্স,
ভাই
চার
বছরের ছোট, দেখতে গেছি চার্লি চ্যাপলিনের ‘দ
গোল্ড রাশ’, সেই
বিখ্যাত
দৃশ্য, প্লেন উল্টো পাক খাচ্ছে,
চ্যাপলিন ঝুলে আছেন, ভাই
উত্তেজিত
হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে, ‘দিদি,
ছাইরে দিছে রে ...’, আমাদের
ঠিক
সামনেই
বসেছিল আমার হাই স্কুলের বন্ধু আর তার ভাই, ওরা
হেসে কুটি পাটি
সে
কথা শুনে, আমার সেই প্রথম আঁতে ঘা লাগলো,
স্কুলে ভালো স্টুডেন্ট বলে
আমাদের
দুই ভাই বোনেরই পরিচিতি আছে, সেখানে
এমন হেলা ফেলা ! কাঁহাতক
সহ্য
হয় !
ঠাকুমা
ছিলেন ঢাকার বড় ঘরের মেয়ে । এন্তার বই পড়তেন । শুনেছি,
রান্না
চাপিয়ে
বই মুখে বসে থাকতেন । আমার নিজের দেখা, বেলা
বারোটার মধ্যে দু
মুঠো
শাকান্ন খেয়ে বই হাতে শুয়ে শুয়ে দুপুর পার করতে,
পরনে পাড়হীন সাদা
থান,
চোখে গোল ফ্রেমের চশমা, টিনের
ট্রাঙ্কে গোটা চারেক তোলা শাড়ি ,
একটা
সাদা শাল, আর বই ... শোয়ার চৌকির তলে সাবান
কেসে লাক্স সাবান,
প্রতি
জন্মদিনে বাড়ির আণ্ডা বাচ্চাদের কপালে জুটতো ধান দুব্বোর আশীর্বাদ
আর
একটা করে সবুজ পাঁচ টাকার নোট । জ্যেঠু লাইব্রেরির মেম্বার ...
অগুন্তি
বই আনে । ওদের থেকে বই পড়ার নেশাটা আমায় ধরে পড়লো । পেপার আর
বইএর
ভাষা শিখতে লাগলাম মন দিয়ে, রবীন্দ্রনাথ,
শরৎচন্দ্র,
বঙ্কিমচন্দ্র
পড়ার জন্য, আর কথা বলার জন্য দুই সমরেশ,
সুনীল,
শীর্ষেন্দু,
সত্যজিত, অতীন,
সঞ্জীব আর আনন্দবাজার গ্রুপের পত্রিকা যত
। তদ্দিনে বুঝে গেছি,
ঘটি নয়, বাটি নয়,
এ ভাষাই সবচেয়ে সেফ, টিকে
থাকতে
হলে ডারউইনের যোগ্যতমের বিবর্তনের থিয়োরি সর্বত্র প্রযোজ্য । যা
কিছু
বাজারে চলে, তাতে
কোন প্রবলেম নেই, তাতে
কারুর কাছে হাস্যকর হতে
হয়
না । তারপর থেকে ভাষার দুটো আমি হয়ে গেলাম, বাড়িতে
আত্মীয় স্বজনদের
সাথে
খাইছি, করছি,
বলছি, আর
বাইরে গ্যালেই একটু চটজলদি মেক ওভার । আর
কেউ
হাসে নি তারপর ।
কলেজে
গিয়ে ফ্রেশারস ওয়েলকামের দিন দেখেছিলাম এক দুর্দান্ত ছাত্রী কেবল
গ্রাম
থেকে আসার কারণে ব্যাপক র্যাগড হয়েছিল । খুব বন্ধুত্ব হয়েছিল ওর
সাথে
। শিল্প মেলায় গিয়ে মেয়েটি কিনেছিল নীল গোলাপ চারা । অনেক বছর বাদে
দ্যাখা
হয়েছিল । ও ততদিনে চাকরি করছে । ঝকঝকে ভাষায় তাক লাগিয়ে দিল । আমি
কুডোস
বলেছি মনে মনে ।
আমি
স্কুলে চাকরি করতে গিয়ে নিত্য দেখি ট্রাইবাল বা একটু আঞ্চলিকতা দোষে
দুষ্ট
ভাষার কারণে অন্যান্য ছাত্রীরা তার পেছনে লাগে । আমার মনে পড়ে সেই
হাসি,
আর ভাইএর সরল ছোট বেলা, ‘দিদি,
ছাইরে দিছে রে’।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন