শনিবার, ১ আগস্ট, ২০১৫

সম্পাদকীয়




সপ্তম সংখ্যার কাজ আজ শেষ করেই উঠলাম। রাত হল বেশ। বকুনী খেলাম। দোষ হল সেই নন্দ ঘোষ ফেসবুক – এর “কি যে আছে ওখানে? ঈশ্বরই জানেন” কথা বাড়ালে আরো বকুনীর সম্ভাবনা। কিন্তু মনে মনে ভাবলাম, শুধু ঈশ্বর কেন? আমিও বিলক্ষণ জানি, কি আছে সেখানে। সেখানে সৃষ্টি আছে, সৃষ্টি সুখের উল্লাস আছে, সেখানে স্বীকৃতি আছে, সেখানে ভাল লাগা আছে, ভালবাসা আছে, সেখানে নিটোল নিটোল সম্পর্কের টানাপোড়েন আছে... ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে গেল আমার দুই বন্ধুর কথা। আজ শোনাব তাদেরই কথা। 

মৃত্তিকা দত্ত আমার গানের ক্লাসের বন্ধু। আমরা ‘মাটি’ বলে ডাকি। বয়সে কিছুটা ছোটই হবে। কিন্তু অদ্ভূত এক ব্যক্তিত্বের ছাপ চোখে-মুখে। শক্ত শক্ত গান অবলীলায় গেয়ে দেয়, শান্ত চোখে তাকায়, মিষ্টি করে হাসে, মৃদু স্বরে কথা বলে... দেখলেই কেমন সমীহ করতে ইচ্ছে হয়। 

মনোহর পুকুর রোডে পুরনো দিনের বিরাট বাড়ি। তারই তিনতলার একটা বড় ঘরে থাকতো মাটি আর কাকিমা। যৌথপরিবার। কিন্তু পরস্পরের মধ্যের বন্ধনটা কেমন জোরাল বলে নজরে পড়ত না। কাকিমা বলতেন, আমার তো সম্বল বলতে এই ঘরখানা আর স্কুলের চাকরী। মেয়েটা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেলেই আমার ছুটি।

সম্ভবত কাকিমাকে তাড়াতাড়ি ছুটি দিতেই গ্রাজুয়েশনের পর মাটি চাকরী নিল একটা এন.জি.ও-তে। কালীঘাটের বিশেষ এলাকার নারী ও শিশুদের নিয়ে কাজ। মাটির চাকরীটা কাকিমার মোটেই পছন্দ হয় নি, এই পর্যন্ত জানতাম। 

তারপর বেশ কিছুদিন কোন যোগাযোগই ছিলনা আমাদের। প্রায় বছর সাত-আট পরে হঠাৎ একদিন ফেসবুকে খুঁজে পেলাম মাটিকে। শুনলাম, পুরনো চাকরীটাই এখনও করে। স্ট্যাটাস বদলেছে বছর তিনেক আগে, বিয়ে করেছে। ওর বর কোন এক গবেষণার কাজে বিদেশে থাকেন। মাটি আপাতত কোলকাতাতেই। একদিকে বৃদ্ধা শাশুড়ি, অন্যদিকে মা – কোলকাতায় এঁদের একা ফেলে যাওয়া সম্ভব নয়। কাকিমা অবশ্য মাটিকে এক্কেবারে ছুটি দিয়ে চলে গেছেন বছর খানেক আগে, এখন বালিগঞ্জ প্লেস-এর বিশাল অত্যাধুনিক ফ্ল্যাটে মাটি আর ওর শাশুড়ি। মুখ ফুটে কিছু বলার মেয়ে নয়, তবুও মাটির একাকীত্বটা কেমন যেন অনুভব করেই নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে শুরু করলাম। 

কথা প্রসঙ্গে একদিন জানলাম, দিল্লীতে এক আন্তর্জাতিক এন.জি.ও-র সদর দপ্তরে মাটির অফিসের একটা মোটা অঙ্কের চেক আটকে রয়েছে কোন এক অজানা কারণে। অনেক মেইল, ফোন করেছে – কোন সুরাহা হয়নি। শাশুড়িকে একা রেখে মাটির পক্ষে এখনই দিল্লী চলে যাওয়া সম্ভব নয়, এদিকে কাজটাও জরুরী, কি করবে বুঝতে পারছে না। তাই চিন্তিত। বললাম, দাঁড়া দেখি – কি করতে পারি।

ফোন করলাম অরণ্যকে। ছোটবেলার বন্ধু। এখন থাকে দিল্লীতে। গবেষণা ও লেখালেখি একাধারে নেশা ও পেশা। বললাম সব কথা। যোগাযোগ করিয়ে দিলাম মাটির সঙ্গে। ক’দিন পরে মাটির কাছে শুনলাম, প্রবলেম সল্ভড। মাটি ‘থ্যাঙ্কস’ জানাল আমাকে, আর আমি অরণ্যকে। তারপর আলাদা করে দুজনের সঙ্গেই কথা হয়। কিন্তু একসঙ্গে দুজনের খবর নেওয়ার কথা মাথায় আসেনি কখনও। 

মাস সাত আট পরে হঠাৎ অরণ্য কোলকাতায় এলো দিন দশেকের জন্য। দেখা হল আমার সঙ্গে, তিনজনেও দেখা করলাম একদিন। শুনলাম ওরা দুজনেও দেখা করেছে আলাদা করে। অরণ্য ফিরে যাওয়ার প্রায় মাস দেড়েক পরে মাটি একদিন ফোন করে এলো আমার অফিসে। এসেই একটা হালকা পিচ রঙের ফ্লোরাল প্রিন্টেড মুখ বন্ধ খাম আমার হাতে দিয়ে বলল, এটা একটু অরণ্যকে পৌঁছে দিও যে ভাবে হোক! বললাম, তুই দিচ্ছিস না কেন? কি এটা? বলল, দিও প্লীজ। খুব তাড়ায় আছি, পরে বলছি সব – বলেই আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল। কেমন যেন মনে হল, পালিয়ে বাঁচল মেয়েটা। 

অরণ্যর ঠিকানা আমার কাছে নেই। ইনবক্স করলাম, ফোন করিস, কথা আছে। রাত পর্যন্ত ‘সীন’ হল না দেখে ফোন করলাম। ফোন বন্ধ। একটা টেক্সটও করে রাখলাম। সকালে উঠেও দেখি সেই একই হাল, কোন সাড়া শব্দ নেই ওই দিক থেকে। মাটিকে ফোন করলাম। আশ্চর্য!! মাটির ফোন বলছে ‘নাম্বার ডাস নট এগসিস্ট’ ...মানে কি? কাল সকালেই তো কথা হল! ইনবক্স করতে গিয়ে আরো আশ্চর্য হলাম। প্রফাইল ডিএক্টিভেটেড। মাটির অফিসের ঠিকানা বা ফোন নম্বর আমার কাছে নেই। সারা দিন এক চরম অস্বস্তিতে কাটিয়ে বিকেলে অফিসের পর কিছুটা ‘শেষ দেখতে হবে’- মনোভাব আর কৌতূহল নিয়ে দৌড়লাম বালিগঞ্জ প্লেস। সিকিউরিটি বলল, মেডামজী ঔর মাইজী তো কালহি সামকো বাহার গেলো, কাফি সামান লিয়ে। কোথাকে গেলো, হামি জানে না। 

ওখান থেকে ফেরার পথে কি মনে করে গেলাম মনোহর পুকুর রোডে। ওখানে কেউ মাটির খবর দিতে পারলো না বটে, তবে মাটির অফিসের ফোন নম্বর পাওয়া গেলো।

পরদিন ফার্ষ্ট আওয়ারেই ফোন করলাম, মাটি সাতদিন আগে চাকরী ছেড়ে দিয়েছে। কোথায় জয়েন করেছে, ওরা জানে না। ওদিকে অরণ্যরও  কোন খবর নেই। এদিকে এই খামটাতেও যে কি আছে, তাও জানি না। সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে দেখে সম্ভাবনার কথা ভাবাও ছেড়ে দিলাম দিন ক’য়েকের মধ্যে।

এমন পরিস্থিতিতে প্রায় আট নয় দিন পর হঠাৎ অরণ্যর  ফোন। বলল, গবেষণার কাজে একদিনের নোটিসে রাজস্থানের একটা প্রত্যন্ত গ্রামে এসেছি রে। এখানে থাকব এখন মাস তিনেক। তাড়াহুড়োয় কাউকে খবর দিতে পারি নি, সরি রে। গ্রামে তো নো কানেক্টিভিটি। আজ শহরে এসে ফোন খুলতেই তোর টেক্সট পেলাম। বল, কি হয়েছে? 

উত্তেজনা চেপে শান্ত গলায় জানতে চাইলাম, তুই যে ওখানে, মাটি জানে? একটু থেমে একটু যেন বিড়ম্বিত আর নীচু গলায় বলল, হ্যাঁ, ও জানে। ওকেও তো ফোন করেছিলাম, পেলাম না। তোর সঙ্গে কথা বলে নিয়ে আবার করছি। 

খুলে বললাম সব কথা। একটু সময় নিলো। তারপর চিন্তান্বিত গলায় বলল, এখানে চিঠি পাঠানো টাফ। তুই এক কাজ কর, চিঠিটা খুলে পড়। আমি দ্বিধা করছি বুঝে তাড়া লাগাল, পড় পড়, আমিই তো বলছি, কিছু হবে না...

শিল্পীর তুলির টানের মতো সুন্দর হাতের লেখা। কোন সম্বোধন নেই। একটা কবিতা –


মেয়েটা আর ছেলেমানুষ নয় 
প্রগাঢ় যৌবনা, বিবাহিতা 
সাধারণের ভীড়ে একেবারে 
মিশে যাওয়ার মতই সাধারণ 
অথচ পৃথিবীর সমস্ত খুঁটিনাটি 
নন্দন তত্ত্বে তার যত্ন নজর... 
বিধাতার কোন্‌ অন্যমনস্কতায় 
এমন সাধারণীর জন্ম ?!

ছেলেটা দূর প্রবাসী, গভীর তার 
প্রজ্ঞা...আরো গভীর অন্তরবীক্ষা 
প্রগাঢ় নিষ্ঠায় সে এক 
আত্মমগ্ন কবি 
বিধাতার অনেক যত্নে গড়া 
অন্ধকার থেকে ক্রমশ আলোর 
উৎসের দিকে ধীর অথচ 
সুদৃঢ় সাবলীল গমন তার।

বৈশাখের এক দগ্ধ দিনের 
শেষে শহরের আকাশে 
যখন ঝড় উঠলো মাতাল হয়ে...
আসলে তো ঝড় নয়, 
মেয়েটার উথাল পাথাল মন... 
এক ঝলক বৃষ্টি এসে ঠাণ্ডা 
করে তাকে। দেখা হল কফির 
দোকানে...। সেই প্রথম। অথচ
আশ্চর্য! সেই তো 
প্রথম নয়!!

ছেলেটার নিষ্পলক অন্তর্ভেদী 
দৃষ্টির ধারে মেয়েটা টুকরো 
টুকরো হতে হতে দ্রব হয়ে 
নদী হয়ে যেতে যেতে... 
এ কুল ও কুল এ কিনারা 
সে কিনারা হয়ে ক্রমশ 
মিশে যেতে থাকে 
ছেলেটার সাত সমুদ্দুর ভালোবাসায়...

এদিকে মেয়েটা একবারও তাকিয়েই 
দেখে না পৃথিবীর যাবতীয় সরল 
দৃষ্টিগুলো ধীরে ধীরে 
ক্রুর, ক্রুদ্ধ, তীক্ষ্ণ, তীব্র, অসহিষ্ণু 
আর অসন্তুষ্ট হয়ে উঠছে।

তোর কপালে দুঃখ আছে, মেয়ে !



রঙীন কাগজটার একেবারে শেষে লেখা – খুঁজো না আমায় আর...

কি অসম্ভব ব্যক্তিগত এ চিঠি, আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। অরণ্যও চুপ। তারপর হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে, ‘একটা এড্রেস টেক্সট করছি, চিঠিটা পাঠিয়ে দে, প্লীজ’ – বলেই রেখে দিলো ফোনটা।

মাটিকে আর খুঁজে পাইনি। অরণ্যর সঙ্গে কথা হয় মাঝে মধ্যে। ভয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারি না। আপনারা কেউ যদি চেনেন বা খুঁজে পান মাটিকে, আমাকে জানাবেন, প্লীজ! আমি যাই, আপনারা ডুব দিন আরো কবিতায়...




শুভেচ্ছান্তে 
সুস্মিতা বসু সিং 





এবং একুশ

1 টি মন্তব্য: